উঁচু উঁচু পাহাড়ের বেষ্টনী, দৃষ্টির সীমানা জুড়ে থাকা পাহাড়সারি, নয়নাভিরাম উপত্যকা, বড় বড় সব পাথরকে পাশ কেটে চলা – সবমিলিয়ে খরস্রোতা সাঙ্গুর বুক চিরে ছুটে চলতে চলতে মনে হবে, হয়তো এই পথের শেষে দেখা মিলবে স্বর্গের!
নৌকা নিয়ে মেঘের মধ্য দিয়ে ভেসে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করলে তা কেবল স্বপ্নই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবেই এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য আপনার চোখে ধরা দেবে বাংলাদেশেই। এই অপার্থিব অভিজ্ঞতা আপনি পাবেন তিন্দু ভ্রমণে।
সাঙ্গু বা সঙ্খ নদী তিন্দু ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। না জানা সব মাথা উঁচু পাহাড় আর তার গা বেয়ে নামা পানির সরু ধারার মাঝে পাথুরে নদীর তীব্র স্রোতের প্রতিকূলে যেতে গিয়ে, হারিয়ে যাবেন যেন অন্য পৃথিবীতে।
তিন্দুর দুই পাশ দিয়ে চলে গেছে দুটো ঝিরিপথ, সেখান থেকে কলকল করে ছুটে আসছে পাহাড় ছুঁয়ে নামা স্বচ্ছ পানি। পানি আর পাথর মিলে এখানে যে সুর তৈরি করেছে, তা আপনাকে ভাবুক করে তুলবে।
তিন্দুপাড়ের বড় বড় পাথুরে সৈকত, লাখ লাখ অসমান পাথর মিলে তৈরি করেছে অমসৃণ সমান একটা পায়ে চলা পথের, হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে এই বুঝি স্বর্গের পথ। ইচ্ছে করবে এখানেই কাটিয়ে আগামী দিন গুলো।
বান্দরবান-কন্যা তিন্দুকে ফেলে যদি আরো ওপরের দিকে এগোতে থাকলে, মনে হবে প্রতিক্ষণে বদলে যাচ্ছে পানির নিচের পাথুরে জগৎটা। ছোট ছোট পাথর যেন আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে উঠতে উঠতে নদীর বুক ছিড়েঁ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল তাদের মাথা। জায়গাটার নাম ‘বড় পাথর’ বা রাজা পাথর।
নদীটা মাঝে মাঝে হয়ে গেছে সিঁড়ির মতন, পায়ের পাতাসমান স্বচ্ছ শীতল পানিতে নেমে ঠেলেঠুলে নৌকাকে ঠেলতে হয় উপরের দিকে, সেখান থেকে আরও উপরে একেবারে মেঘের কাছাকাছি।
এখানে শুধু নানা আকৃতির পাথর আর পাথর। পাথরের ফাঁক গলে এগিয়ে চলে নৌকা। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো গাছগুলো দেখে বিমুগ্ধ হবেন। আর পায়ের নিচে পাথুরে সাদা বালি চিক চিক করছে। এ এক অন্য সৌন্দর্যের ভুবন। প্রকৃতি যেন এখানে সব সৌন্দর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে।
দেখা মিলে পাথর আর পানি মিলে ভরদুপুরে তৈরি করে রংধনুর। উত্তুরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা রংধনু গুলোকে আপন কোলে আশ্রয় দেয় নদীর পাড়জুড়ে ঝুলতে থাকা গাছের সবুজ পাতারা। সূর্যোদয় দেখতে হয় মেঘ সরিয়ে, এখানে সূর্যাস্ত দেখতে হয় পানির চোখে চোখ রেখে।
পানি আর পাথরের এক সাদা-কালো স্বপ্নময় জগত গড়ে উঠেছে এই তিন্দুকে (Tindu) ঘিরে। পাহাড়গলা পানিতে পা ডুবিয়ে চলার পথের নতুন নতুন মাছের সঙ্গে সারা দিন লুকোচরি দিলেও ক্লান্তির ঘাম ঝরবে না কানের লতি বেয়ে, ঘোলাটে মেঘের ভিড়ে সারাক্ষণ ভিজতে থাকলেও এতটুকু ময়লা লাগবে না গায়ে। এটা পাথুরে পানির, এটা সবুজ পাহাড়ের, এটা মেঘের, এটা কুয়াশার দেশ, এটা তিন্দু, মেঘ-কুয়াশার তিন্দু।
প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে পর্যটকদের কাছে অঞ্চলটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবেই বেশ পরিচিত। তাই আপনি যদি একটু প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এই স্থানের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার ভুলটি কখনও করবেন না।
কিভাবে যাবেন?
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়া যায় দুইভাবে; বাসে কিংবা রিজার্ভ জীপে। বান্দরবানের থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে এক ঘণ্টা পর পর লোকাল বাস থানচির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগবে ৪-৫ ঘন্টা।
রিজার্ভ জীপ/চান্দের গাড়িতে গেলে সময় লাগবে ৩-৩.৫ ঘন্টা। থানচি যাওয়ার সময় পথে পরবে মিলনছড়ি, চিম্বুক ও নীলগিরি। চারপাশের অপুর্ব দীর্ঘ পাহাড়ি পথের এই ভ্রমণ আপনার চোখ ও মনকে সতেজ করে রাখবে।
থানচি (thanchi) পৌঁছে আপনাকে একজন গাইড ঠিক করতে হবে। গাইড ছাড়া তিন্দু ভ্রমণে যেতে পারবেন না। উপজেলা প্রসাশন থেকে অনুমতি পাওয়া যে কাউকে গাইড হিসেবে নিতে পারবেন। এরপর গাইডের সাহায্যে আপনাকে থানচি বিজিবি ক্যাম্প/থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। ভ্রমণকারী সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কোথায় যাবে, কয়দিন থাকবে এইসব তথ্য কাগজে লিখে জমা দিতে হবে।
অনুমতি পাওয়ার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করতে হবে। থানচি থেকে নৌকায় তিন্দু যেতে সময় লাগবে দুই ঘন্টার মত। সাঙ্গুতে পানি কম থাকলে কিছু জায়গায় নৌকা থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে তখন সময় একটু বেশি লাগতে পারে। যাবার পথে সাঙ্গু নদীর (sangu river) রূপ আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে।
ভ্রমণ সতর্কতা ও টিপস
- থানচি থেকে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।
- থানচি থেকে তিন্দু যেতে হবে পানি পথে যাতায়াতে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন।
- এক নৌকায় ৪-৫ জন যেতে পারবেন।
- তিন্দুতে বিজিবি ক্যাম্প আছে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
- নিজের আইডি কার্ড বা তার ফটোকপি রাখবেন।
- তিন্দুতে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করেনা। কিছু জায়গায় রবি ও এয়ারটেল তুলনামূলক ভাল কাজ করে।
- বিদ্যুতের ব্যবস্থা বলতে সোলার সিস্টেম। সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন।
- সাঙ্গু নদীতে পানির স্রোত অনেক, গোসল করতে গেলে অবশ্যই সাবধান থাকবেন।
- স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের সাথে অশালীন আচরণ করবেন না।
- বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা, ভিডিও করা বা এমন কিছু করবেন না যেন তারা বিব্রত হয়।
গাইড এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত যে কোন তথ্যর প্রয়োজনে সফরসংগী 01841497987/01707500505.