ভয়ংকর সুন্দর। শব্দটি আমরা কম-বেশি সবাই শুনে থাকলে ও এই সুন্দরের ভয়ংকর রূপ উপভোগ করতে পারি কয়জন। আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো একই সাথে এক প্রকৃতির সুন্দর এবং ভয়ংকর রূপ উপভোগ করার। বলছি নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের কথা।
বছরের অন্যান্য সময় যে ঝর্ণা গুলো রাজার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে প্রকৃতির আড়ালের ভিতর, সেই ঝর্ণাই কিনা বর্ষাকালে পরিণত হয় এক একটি ভয়ংকর মৃত্যুকূপে। যা কিনা কোন ট্রাভেল ব্লগ কিংবা ছবি দেখে বিশ্বাস করা অসম্ভব । নিজের চোখে না দেখলে তা অসম্ভবই থেকে যায়।
ওয়েদার ফরকাস্ট, দলের অন্যান্য সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে অক্টোবর মাসের প্রথম শুক্রবার সকাল আটটায় বাসে উঠে বসি আমি এবং দলের অন্যান্য সদস্যরা। সাত জন ছেলে এবং তিনজন মেয়ে নিয়ে আমাদের ১০ জনের টিম। গন্তব্য মিরসরাই এর নদুয়ার হাঁট। সেখানে পৌঁছে একজন স্থানীয় গাইড নিয়ে শুরু হলো আমাদের ট্রেইলের প্রস্তুতি।
কিছুক্ষণ গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা, কিছুক্ষন ঝিরিপথ, কিছুক্ষন খাড়া পাহাড় পাড়ি দিতে হয় এই ট্রেইলে। কখনো কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি, আবার কখনো ঘোলাটে পানির মধ্যে লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করছিলাম সুন্দর প্রকৃতি। এর মত সহজ ট্রেইল যেন আর হয় না এবং এর মত মনোরম ট্রেইল যেন আর হয় না, এমন কথা বের হচ্ছিল হৃদপিণ্ডের স্পন্দন এর মধ্য দিয়ে।
এভাবেই যখন কুপিকাটা ক্যাস্কেড, কুপিকাটাখুম, মিঠাছড়ি পাড় করে বান্দরখুম গেলাম, তখন যেন কিছুতেই ঝর্ণা ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না আমার। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে নেমে আসে প্রবল বৃষ্টি। গাইডের কথামতো ফেরার পথ ধরি আমরা সবাই।
মাত্র ৩০ মিনিটের বৃষ্টিতে চেনা পথ হয়ে গেল অচেনা। বেশ কিছুক্ষণ আগে যে পথ স্বচ্ছ পানিতে এবং পাথরে পরিপূর্ণ ছিল সে পথ যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধুমাত্র লাঠি দিয়ে পানির নিচে কি রয়েছে তা আন্দাজ করা ছাড়া কোনো পথই রইল না। সুন্দর পাথরে ঘেরা ঝিরি পথ গুলো যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হল।
প্রচণ্ড স্রোতে কয়েক বার ভেসে যেতে যেতে ও রক্ষা পেলাম। আশে-পাশের অন্যান্য টিমের মধ্যে যেখানে কান্নার রোল পড়ে গেলো, সবাই অনিশ্চিত প্রাণ নিয়ে ঘরে ফেরা হবে কিনা। সেখানে আমাদের টিমের সিনিয়ররা ক্রমাগত সাহস যোগাচ্ছিলো সবাইকে।
১ ঘন্টা স্রোতের অনুকূলে-প্রতিকূলে লড়াই করে যখন ফেরার পথ খুঁজে পাই, তখনই বুঝতে পারি প্রকৃতির রূপ কত ভয়ংকর হতে পারে। এইসব নিদর্শন দেখানোর জন্য, নাকি নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য, মহান আল্লাহর শোকর আদায় করব তা বুঝতে পারছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ।
সেই নাপিত্তাছড়ার সুন্দর রূপকে ভয়ংকর হয়ে উঠতে দেখে শুধু,
একটা কথাই বাজে
সারা হৃদয় ঘিরে
যেতে পারি আবার যাতে
এই ভয়ঙ্কর অভিযানে।
-রাফি সরওয়ার তাছিন