লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কিছু ছবি
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
সবুজ প্রকৃতির মনকাড়া রুপমাধূর্য্য আর দিগন্তজুড়ে মন খোলা সবুজের হাতছানি। উঁচু নিচু পাহাড়ের গায়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার প্রজাতীর লাখ লাখ বৃক্ষ, চারিদিকে হালকা অন্ধকার রাস্তায় দুপাশের বৃক্ষগুলো সূর্যের আলোক রশ্মিকে আটকে রেখেছে।
ঘন সবুজ বনের ভিতরে ঠিকরে পড়ে সূর্যের আলো, গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে চলে এই আলো-ছায়ার লুকোচুরি খেলা। ঝোপঝাড় ভেদ করে ঠিকই কানে আসে অসংখ্য পাখির ডাক। মাঝে মাঝে বৃক্ষসারির মগডালে বানর আর হনুমান লাফালাফি করছে আপনার অর্ভ্যথনায় ।
বনের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মত এক ধরনের ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য রকম সুরের জগতে।
ভিতরে যেতে যেতে চোখে পড়বে খাটাস, বনমোরগ, উল্লুক, মেছোবাঘ, বন বিড়ালসহ বিভিন্ন জীবজন্তু আর বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজি, জীবজন্তুর হুঙ্কার, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, বানরের লাফালাফি, উল্লুকের ডাকাডাকি একটু সময়ের জন্য হলেও জীবনের ক্লান্তি দূর করে মনে এনে দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া ।
উঁচু নিচু ও আলো আঁধারের চোখ ধাঁধানো খেলা, পাখির কিচিরমিচির, ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান সব কিছু মিলিয়ে অদ্ভুত জাদুতে আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে।
সবুজ বনজ জঙ্গল আর লতাগুল্মের মধ্যেই নানা জাতের বন্যপ্রাণীর নিবাস। সূর্যোদয় কিংবা গোধূলিলগ্নে বাসিন্দারা জানান দেয় এটাই তাদের আপন ভুবন। তাদের হাক ডাক আর হৈ হুল্লুড়ে বুঝা যায়, এই স্থান বন্যপ্রাণীর।
নানা রং আর আকার আকৃতির পোকা-মাকড়ের ঝিঁঝিঁ শব্দ, বিচিত্র সব পশুপাখির কিচিরমিচির, দলবদ্ধ বানরের লাফ ঝাঁপ আর ভেঙচি। এক গাছ থেকে অন্য গাছে কাঠবিড়ালী আর উল্লুকের দৌড়ঝাঁপ। সাপ, হরিণ, বানর, শিয়াল আর নানা জাতের বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ এই বনে।
বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী, বনজ ও ঔষুধি গাছগাছালি আর লতাগুল্ম আর নানা জাতের পাখি আর সবুজ প্রকৃতির হাতছানিতে ভরপুর ‘ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট’ হিসেবে খ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। যেখান থেকে আপনি নিতে পারেন প্রকৃতির আদিম কিংবা বুনো স্বাদ।
ইতিহাস
সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পূর্ববতী নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। ১৯১৭ সালে আসাম সরকার এই বনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৫ সালে তৎকালীন বিট্রিশ সরকার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের পশ্চিম ভানুগাছ ফরেস্টের কিছু ন্যাচারাল বনের সঙ্গে (কমলঞ্জের বৃহৎ অংশ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে) ১২৫০ হেক্টর এলাকাজুড়ে সেগুন, লোহা, চাপালিশ, জারুলসহ বেশ কিছু জাতের বৃক্ষ বনায়ন করেন।
চারদিকে চা বাগান, হাওর ও সংরক্ষিত বন থাকায় এবং বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা হওয়াতে দ্রুত এই বনটি বেড়ে ওঠে। এসব গাছপালা বেড়েই লাউয়াছাড়া বনের সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। লাউয়াছড়ার আগের নাম ছিলো পশ্চিম ভানুগাছ রিজার্ভ ফরেস্ট, যার এরিয়া ১২৫০ হেক্টর। বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও সংশোধন), অর্ডিনেন্স ১৯৭৪ অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই এটাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়।
বনটির অবস্থান ২৪১৯১১ উত্তর, ৯১৪৭০১ পূর্ব, এর মূল অংশ পড়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। একেবারে পাশের শহর শ্রীমঙ্গল। রাজধানী ঢাকা থেকে ২০০ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৮ কিঃ মিঃ পূর্বে লাউয়াছড়ার অবস্থান।
মৌলভীবাজার বন রেঞ্জ থেকে বাদ দিয়ে এটিকে হস্তান্তর করা হয় মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের হাতে। বলা চলে এ বনকে সামনে রেখে মৌলভীবাজারে গড়ে উঠে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার যাবতীয় কর্মকাণ্ড।
যেখানে দেয়া হয় একজন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, একজন সহকারী বন কর্মকর্তা, একজন রেঞ্জার, কয়েকজন বিট কর্মকর্তা ও বেশ কিছু বন প্রহরী।
ভূপ্রকৃতি
লাউয়াছড়া উদ্যানের (Lawachara Rain Forest) ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি মৃত্তিকায় গঠিত। উঁচু-নিচু টিলা জুড়ে এ বন বিস্তৃত। মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি এবং প্রচুর পাথর দেখা যায়। বনের মাটিতে পাতা জমে জমে পুরু স্পঞ্জের মতো হয়ে থাকে, জায়গায় জায়গার মাটিই দেখা যায় না।
এসব স্থানে জোঁকের উপদ্রপ খুব বেশি। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে অনেকগুলো পাহাড়ী ছড়া। কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোতে শুধু বর্ষার সময়ই পানি থাকে এসব ছড়াতে। ছড়ার পানি পরিষ্কার টলটলে এবং ঠান্ডা। শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেসব ছড়ার কাছেই বন্যপ্রাণীর আনাগোনা দেখা যায়।
জীববৈচিত্র্যে
বাংলাদেশের বনগুলোর মধ্যে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার (Lawachara Rain Forest) অবস্থান। বাংলাদেশের অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ লাউয়াছড়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ বর্ষায়ন বা রেইন ফরেস্টের মতো প্রচুর বৃষ্টিপাত (Rain) হয়। সূর্যের আলোর জন্য প্রতিযোগিতা করে বনের গাছপালা খুব উঁচু হয়ে থাকে এবং অনেক উপরে ডালপালা ছড়িয়ে সবুজ চাঁদোয়ার মতো সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই রেইন ফরেস্টে রয়েছে প্রায় ৪৬০ প্রজাতির জীব বৈচিত্র্য যেসবের মধ্যে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ২৪৬ প্রজাতির পাখি।
বন বিভাগের সূত্র মতে, এর ভেতরে রয়েছে ডুমুর, রক্তন, চাপালিশ, ডেওয়া, সেগুন, আমলকি, জলপাই, আওয়াল (লাল, সাদা), উদল, রাতা, বহেড়া, তেলসুর, লটকন, বনাক, গামার, বাটনা, বিওলোম, চালমুগড়া, বিরল প্রজাতির আফ্রিকান টিক ওক, কদম, লোহাকাঠসহ ১৬৭ প্রজাতির লতা ও গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ।
এর মধ্যে আফ্রিকান টিক ওকটি (African Teak oak) এশিয়ার মধ্যে এখন পর্যন্ত এ লাউয়াছড়া বনেই দুটি গাছ রয়েছে যারমধ্যে ঝড়ে একটি গাছ পড়ে যায়, অন্যটি রয়েছে বিট অফিসের পাশে। এ বনে রয়েছে বেশ কিছু বেত বাগান ও বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ বাগান।
লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণির মধ্যে রয়েছে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী (পৃথিবীতে, ৫৪০০ এবং বাংলাদেশে ১২১ প্রজাতির। এর মধ্যে রয়েছে
- উল্লুক
- লজ্জাবতী বানর
- ক্যাপড্ লেংগুর (Capped langur)
- পিগ টেইল ম্যাকাক (pig-tailed macaque)
- ফ্যারিজ লিফ মাংকি (phayre’s leaf monkey)
- বানর (Monkey)
- মায়া হরিণ (Indian Muntjac or Barking Deer)
- কমলা বুকওলা কাঠবিড়ালী
- শেয়াল (Jackal)
- মেছো বিড়াল (Fishing Cat)
- বন্য শূকর (Wild boar)
- সজারু (Indian Crested Porcupine)
- খাটাশ (Civet)
- জংলি বিড়াল
- ভোঁদড় (Mustelidae)
এ বনে রয়েছে ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ (পৃথিবীতে ৮৩০০ ও বাংলাদেশে ১৫৮ প্রজাতি)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো
- অজগর (pythons)
- গোখরো (Indian cobra)
- পিট ভাইপার (Pit vipers)
- গুইসাপ (Monitor Lizard)
- হিমালয়ী ধোরা সাপ (Himalayan Mountain Keelback)
উভচর প্রাণি রয়েছে ৬ প্রজাতির (পৃথিবীতে ৫৮০০, বাংলাদেশে ৫৩ প্রজাতির)।
পাখি রয়েছে ২৪৬ প্রজাতির (পৃথিবীতে ৯৯০০, বাংলাদেশে ৬৯০ প্রজাতির)। উল্লেখযোগ্য হলো পাহাড়ী ময়না
- ধনেশ (Hornbill)
- মথুরা
- সবুজ ঘুঘু (common emerald dove)
- বন মোরগ (red junglefowl)
- ঈগল (eagle)
- কালোমাথা টিয়া (Grey-headed Parakeet)
- পেঁচা (owls)
- ফিঙ্গে (black drongo)
- কালোবাজ
- বড় মালাপেঙ্গা (greater necklaced laughingthrush)
- বারবেট,
- বক (Heron)
এ ছাড়াও লাউয়াছড়ায় ১৬০ টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। রয়েছে সহস্রাধিক জাতের পোকামাকড়।
এ বনে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের (Hoolock Gibbon) বসবাস। পৃথিবীর যে চারটি দেশে উল্লুক দেখা যায় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উল্লুকের একক ও বৃহত্তম আবাসস্থল। বনের মধ্যে সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে।
বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে প্রানীটি। লাউয়াছড়ার বনে বর্তমানে মাত্র ৪৯ টি উল্লুক অবশিষ্ট আছে। ছাউতলি ও কালাছড়ার বন মিলিয়ে এ সংখ্যা ৬০ এর মত। লাউয়াছড়া ও এর আশপাশের বনে মোট ১৬ টি উল্লুক পরিবার রয়েছে। ভোরবেলা অনেক সময় উল্লুকের দেখা পাওয়া যায়। উল্লুকের প্রিয় খাদ্য চামকাঁঠাল বা চাপালিশ ফল রয়েছে এ বনে।
আদিবাসী
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের (Lawachara Rain Forest) ভেতরে সীমানা সাথে ও পশ্চিম ভানুগাছ বনের ভেতরে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৮ টি গ্রাম। উদ্যানের ভেতরে কোর জোনে ২ টি গ্রাম (খাসিয়া আদিসাসী) বিদ্যমান, তবে জানকিরছড়া নামক স্থানের ডলুবাড়িতে সীমানা ঘেঁষে টিপরা আদিবাসীর বসতি।
আদিবাসী খাসিয়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক, হিন্দু ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোক, টিপরা সম্প্রদায়ের লোক (মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোক) এবং অবশিষ্টরা অধিকাংশ স্থানান্তরিত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক।
যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে বসতি স্থাপন করে। এর মধ্যে বেশিরভাগ নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল ও ভারতের আসাম থেকে আগত।
একটি গ্রাম দেখতে পাওয়া যায় লাউয়াছড়ার পশ্চিম প্রান্তে। গ্রামটি মূলত খাসিয়া পল্লী (পুঞ্জি, খাসিয়াদের ভাষায়।) ছোট একটি ছড়া পার হয়েই খাসিয়া পল্লীতে প্রবেশ করতে হয়। টিলার উপরে খাসিয়াদের মাচাং ঘর, আনারস বাগান ও তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস পান চাষের বরজ বা ক্ষেত।
পান চাষ করতে খাসিয়া পুরুষরা চারা রোপন, গাছের উপর উঠে পান নামানো ইত্যাদি কাজ করে থাকে। মেয়েদের কাজ পানগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে আটি বেঁধে পাইকারদের নিকট বিক্রি করা। খাসিয়াদের বর্ণাঢ্য জীবনধারা মুগ্ধ করবে সবাইকে।
দর্শনীয় স্থান
চায়ের দেশ হিসেবে খ্যাত সিলেট (sylhet) বিভাগের যতগুলো দর্শনীয় স্থান আছে তার মধ্যে লাউয়াছড়া জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানটি পাখি, সরীসৃপ প্রাণী ও উল্লুকসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণী দেখার জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। আসার পথে রাস্থার দুই পাশে চোখে পড়বে চা-বাগান। উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলায় চায়ের বাগান দেখে মনে হবে যেন সবুজ সমুদ্র ঢেউ খেলছে।
এছাড়া যে স্থান গুলো মুগ্ধ করবে
- রেইন ফরেস্ট (Rain Forest)
- চা বাগান (Tea garden)
- রাবার বাগান
- আগর বাগান
- মাধবকুন্ড জলপ্রপাত (Madhabkunda Waterfall)
- হামহাম জলপ্রপাত
- মাধপুর লেক
- আলী আমজদের নবাব বাড়ি
- কমলা ও লেবুর বাগান
- সাত রঙের চা
- খাসিয়া পুঞ্জির পান চাষ
- হাকালুকি হাওর (Hakaluki Haor)
- বাইক্কা বিল (Baikka Beel)
পায়ে হাঁটা পথ বা ট্রেইল
লাউয়াছড়া বনে রয়েছে তিনটি প্রাকৃতিক ‘ফুট ট্রেইল’ বা পায়ে হাঁটা পথ। তিনটি পথ ধরেই আপনি হারিয়ে যেতে পারেন সবুজের মাঝে আদিম হয়ে।
আধ ঘণ্টার পথ
শুরুটা রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। নানারকম উঁচু উঁচু গাছগাছালির ভেতর দিয়ে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন, মুগ্ধ হয়ে যাবেন ঝিঁঝিঁ পোকার গান, দেখা হয়ে যেতে পারে কুলু বানরের। গাছের ডালে দেখা মিলবে বুনো অর্কিড। হাতের বাঁয়ে চলতে চলতে এই পথ আবার শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানে।
এক ঘণ্টার পথ
ট্রেকিংয়ের শুরুতেই দেখবেন বিশাল গন্ধরুই গাছ যার আরেক নাম কস্তুরী। এ ছাড়া এ পথে দেখবেন কাঠালি চাঁপা, ঝাওয়া, জগডুমুর, মুলী বাঁশ, লেহা প্রভৃতি গাছ। আরো আছে প্রায় শতবর্ষী চাপলিশ আর গামারি গাছ।
এ পথে নানারকম ডুমুর গাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর, হনুমান ছাড়াও বনের বাসিন্দা আরো অনেক বন্যপ্রাণী ,যাদের সামনেও পড়ে যেতে পারে। পথে দেখা মিলতে পারে মায়া হরিণ (Barking Deer) আর বন মোরগের।
তিন ঘণ্টার পথ
তিন ঘণ্টার হাঁটা পথটি সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর। পথের বাঁয়ে খাসিয়াদের বসত মাগুরছড়া পুঞ্জি যা ১৯৫০ সালে বন বিভাগ তৈরি করে। বাসিন্দারা মূলত পান চাষ করে জীবপযাপন করে। পথে দেখা মিলবে বিশাল বাঁশবাগান যেখানে কুলু বানর আর বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর। বাস। লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলায় বাঁশের ঝারে ঘুমিয়ে কাটায়। এ ছাড়া এ পথে দেখা মিলবে নানান প্রজাতির পাখির, আর পথের শেষের দিকে দেখা মিলতে পারে এ বনের অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক পরিবারের। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।
কিভাবে যাবেন
ট্রেন (Train) হচ্ছে ঢাকা থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেতে সবচেয়ে ভাল মাধ্যম। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যেতে কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশান হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার সফর সঙ্গী হিসাবে। ট্রেনে যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা।
বাসে করে ঢাকা (Dhaka) থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়দাবাদ থেকে। সেখান থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস, এনা ইত্যাদি নন এসি বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগে ৪ ঘন্টার মত।
চট্টগ্রাম থেকে বাসে বা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল (sreemangal) যেতে পারবেন। চট্টগ্রাম (chattogram) থেকে ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে, পাহাড়িকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস নামের দুটি ট্রেন সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে।
শ্রীমঙ্গল পৌঁছানোর পর সেখান থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী যো কোন গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে। গাড়িতে করে যেতে ১৫-২০ মিনিট লাগে।
জেনে রাখা ভাল
- যেহেতু সংরক্ষিত বনাঞ্চল তাই চলাচল সাবধানতা বজায় রাখুন।
- হৈ চৈ করবেন না, এতে বন্য প্রানীদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যহত হয়।
- যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না এতে বনের জীব বৈচিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
- অপরিচিত কারো সাথে একা একা বনের গভীরে যাবেন না। বনের গভীরে যাওয়ার জন্য গাইডের সাহায্য নিন।
- রেললাইন ধরে হাটার সময় ট্রেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
- কম খরচে ভ্রমণ করতে চাইলে রিজার্ভ গাড়ি না করে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ রোডের লোকাল সিএনজি অথবা বাস দিয়ে যাতায়াত করতে পারেন।
- জঙ্গলের পশুপাখিদের নিজস্ব জগত আছে, উচ্চস্বরে গান বাজনা করবেন না, কথা বলবেন না। এতে বন্য প্রানীর ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
- শীতকাল ছাড়া অন্য যে কোন সময় গেলে খুব সাবধানে থাকবেন। এই জঙ্গলে প্রচণ্ড জোকের উৎপাত, ঘাড়, হাত, পায়ের দিকে সতর্ক নজর রাখবেন, বিশেষ করে ছড়ার আশেপাশে জোকের পরিমান বেশি থাকে। জোক কামড়ালে টেনে ছাড়াতে যাবেন না। লবণ সাথে রাখবেন, জোকের শরীরে লবণ ছিটিয়ে দিলেই কাজ হবে। লবণ না থাকলে সিগারেটের তামাকেও কাজ চালাতে পারেন।
- সাপ খেয়াল রাখবেন
- জঙ্গলের ভেতরের রেল লাইন ধরে হাঁটাহাঁটি করা সময় সাবধানে থাকবেন।কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন যাতায়াত করে এই রেলপথ দিয়ে, যে কোন সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
- বন্য প্রাণীর আক্রমণের আশঙ্কা থাকায় বনের ভেতরে যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও গাইডের সহযোগিতা নিন।
- টাকা লাগলেও গাইডের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আপনার ভ্রমণে আনন্দের মাত্রা দ্বিগুন করবে।
লাউয়াছড়ার বনের মাঝদিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন। রেললাইনের দু’পাশের গাছগাছালীর মাঝ দিয়ে ট্রেনের কুঁ-ঝিকঝিক করে ছুটে চলা শব্দের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার সুর মিলে এক মনোরম সুরের সৃষ্টি করে। উপভোগ করা ছাড়া এর বর্ননা করা কঠিন। আপনজনকে নিয়ে ছুটে চলতে চলতে হারিয়ে যাবেন নতুন এক জগতে।
এছাড়া লাউয়াছড়া যাবার পথে চোখে পড়বে চা-বাগান, উচু-নিচু টিলা, আনারস, লিচু ও লেবু বাগান। রাস্তার দুপাশেই সবুজের ছড়াছড়ি, মনে হবে যেন সবুজের গালিছা বিছানো একটি স্বর্গরাজ্য।
জানা যায় ইউএসএইডের অর্থায়নে আইপ্যাক (সমন্বিত সংরক্ষিত এলাকা) সহায়তা প্রকল্পের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালনায় বাংলাদেশের যে ৫টি অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও টেকনাফ জাতীয় উদ্যান।
লাউয়াছড়ায় আপনি যেতে পারেন বছরের যেকোন সময়। তবে যারা বৃষ্টি ভালবাসেন তাদের জন্য বর্ষার সময়টাই শ্রেয়। বনের গভীরে কোন খাসিয়া ছাউনিতে বসে, গাছের পাতায় বৃষ্টি (rain) পড়ার শব্দ আর বৃষ্টি বিলাসের বর্ণনা করা অসাধ্য।
যদি কোন সহায়তার প্রয়োজন পরে কিংবা আর কিছু জানার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সাহায্য নিতে পারেন এই নাম্বারে ফোন করে 01841497987/01707500505.